অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওন পড়েছিলেন প্রতারক চক্রের ফাঁদে। তাকে বিকাশে ৩১ হাজার টাকা পাঠাতে বলা হয়। তিনি তা পাঠিয়ে দেন। এর পর থেকে লাপাত্তা প্রতারকরা।
প্রতারকদের একজনকে বুধবার গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। আর তখনই প্রকাশ্যে আসে শাওনের প্রতারিত হওয়ার তথ্য।
কীভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন, তা দৈনিক বাংলাকে জানিয়েছেন শাওন।
ঘটনার শুরু জানিয়ে শাওন বলেন, ‘জুনের ১৭ কিংবা ১৮ তারিখে আমাকে একজন ফোন করে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার পারসোনাল সেক্রেটারি (পিএস) হিসেবে পরিচয় দেন; জানান যে, ডেপুটি স্পিকার আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি বলি ঠিক আছে। ফোন নিয়ে একজন নিজেকে ফজলে রাব্বী বলে পরিচয় দেন। আমার খোঁজখবর নেন। নুহাশ পল্লী ঠিকঠাক আছে কি না, পরিচালনা করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, খোঁজখবর নেন।
‘একপর্যায়ে তিনি বলেন যে আমি আসলে আপনি আপনি করে না বলে তোমাকে তুমি করে বলি। তোমার আম্মা তো আমার কলিগ ছিলেন। আমিও ভাবলাম ঠিকই তো, আমার আম্মা এমপি ছিলেন। সেই হিসেবে তিনি আমার আম্মার কলিগই ছিলেন। সে জন্য আমিও বলি, অবশ্যই আপনি আমাকে তুমি করে বলেন।
‘একপর্যায়ে তিনি বলেন যে, নুহাশ পল্লীতে অস্ট্রেলিয়ান একটা এনজিও গ্রুপ বেড়াতে গিয়েছিল, তারা খুব পছন্দ করেছে জায়গাটা। এনজিওটি অফিশিয়ালি একটা অনুদান দিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নামে একটা কিছু করার জন্য। আমি যতদূর জানি তুমি একটা মিউজিয়াম করতে চাও। তো অনুদানটা তুমি নিতে পারো। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে তোমার কাছে অনুদানটা পৌঁছে দেয়ার।’
শাওন বলতে থাকেন, ‘আমি ভাবলাম, এমন হলে তো আমার জন্য সম্মানজনক। সম্মতি পেয়ে তিনি বলেন, এটা তো অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত উপসচিবকে তোমার মোবাইল নম্বর দিচ্ছি। উনি ফোন করে তোমার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে নেবেন।’
তিনি বলেন, ‘ওই দিনই দেড়-দুই ঘণ্টা পর আমার কাছে ফোন আসল অতিরিক্ত উপসচিব পরিচয় দেয়া একজনের। আমার ফোনে ট্রু কলার আছে, সেখানেও দেখলাম তার নাম মিলে গেছে এবং পাশে অর্থ মন্ত্রণালয়ও লেখা আছে। তো আমি কথা বললাম। আমার মা যখন এমপি ছিলেন, তখন আমি দেখেছি, তাদের আলোচনা, ভাষা, সম্বোধন কেমন হয়। এই প্রতারকরাও সেই ভাষা, ভদ্রতা একদম পুরো মেইনটেইন করেছে। তাদের কথা শুনে আমার একটুও সন্দেহ হয়নি।
‘তারা সুন্দর করে ম্যাডাম সম্বোধন করে অ্যাকাউন্ট নম্বর জানতে চাইলেন, অনুদানের টাকার পরিমাণটাও ভগ্নাংশ রেখে, দশমিক রেখে জানালেন। ১৬ লাখ টাকার অনুদানে ট্যাক্স বাবদ ২৫ হাজার টাকা আসে বলে জানান। আরেকটি চার্জ মিলিয়ে ৩১ হাজার ৮৫০ টাকা বিকাশ করতে বলেন। তাহলে তারা প্রসেসিং শুরু করতে পারেন বলে জানান।’
শাওন আক্ষেপের স্বরে বলেন, ‘এই জায়গাটাতে আমি একটু ভুল করেছি। আমাকে যেহেতু সরকারি ফির কথা বলে টাকাটা নিয়েছে, সেখানে তো রিসিট থাকবে বা কাগজপত্র থাকবে।
‘হুমায়ূন আহমেদ, তার মিউজিয়াম আমার কাছে একটা ইমোশনাল ব্যাপার। আমি এসব বিষয় মাথায় নিয়ে ভুল করে ফেলেছি। আমি সেদিনই বিকাশ করি। এক বারে ৩১ হাজার টাকা যায় না, তাই দুই ধাপে বিকাশ করলাম।’
শাওন আরও বলেন, ‘বিকাশে টাকা পেয়ে ডেপুটি স্পিকার পরিচয় দেয়া ব্যক্তি ফের ফোন করেন। তিনি অনুদানের চেকটা অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে হাতে হাতে দিতে চান। অস্ট্রেলিয়ান দুই-তিনজন কর্মকর্তা নাকি দেশেই আছেন, তারা নুহাশ পল্লীতে চেক পৌঁছে দেবেন, রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলে তিনিও আসতে চাইলেন। ২০-২৫ জনের খাবারের আয়োজন করতেও বলেন তিনি। তেমন কিছু না সাদা ভাত, একটু সবজি, ডাল, মাছ। লোক বাড়তেও পারে। সেটি তিনি আমাকে পরদিন জানাবেন।
‘সত্যি বলতে, তারা এত স্মার্ট যে আমি সব বিশ্বাস করেছিলাম। তাদের কথা অনুযায়ী খাবারের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিলাম নুহাশ পল্লীর ম্যানেজারকে। পরদিন আমি ম্যানেজারকে খবর নিতে বললাম। তখন ম্যানেজার জানান, সেই ফোন বন্ধ। এরপর আমি চেষ্টা করে দেখলাম, সেই নম্বর বন্ধ, সেই উপসচিবের ফোন বন্ধ। তখন আমার মনে হলো আমি বোকামিটা করে ফেলেছি।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনা বুঝে এক দিন পরই আমি ধানমন্ডি থানায় রিপোর্ট করি। অনেকেই আমাকে বলেছিল যে, অপরাধী ধরা পড়বে না, কিন্তু আমি ধানমন্ডি থানা ও ডিবির কাছে কৃতজ্ঞ যে, অপরাধী ধরা পড়েছে।
‘টাকার পরিমাণটা যাই হোক, আমার মনে হয়েছে, আমার মতো সচেতন মানুষ যদি এ রকম ভুল করে ফেলতে পারে, তাহলে আরও অনেকেই এ রকম ভুল করতে পারে। আমি শুনলাম ডেপুটি স্পিকার মারা যাওয়ার পর মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে নাকি চক্রটি প্রতারণা করছিল। তাই বিষয়গুলো মানুষের জানা দরকার। এভাবে যে প্রতারণা হচ্ছে, সে তথ্য ছড়িয়ে দেয়া দরকার।’
মেহের আফরোজ শাওনের কাছ থেকে ফোন প্রতারণার মাধ্যমে ৩১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ডিএমপির ডিবি গ্রেপ্তার করেছে রবিউল ইসলাম নামের ব্যক্তিকে।
ডিবির প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে জানান, বুধবার রাত দেড়টার দিকে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম গাইবান্ধায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক রবিউলকে গ্রেপ্তার করে। প্রতারক চক্রটি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার, বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিচয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় অবস্থান করা রবিউল বিভিন্নজনের কণ্ঠ নকল করে প্রতারণা করেন বলে জানায় পুলিশ। ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে রবিউল ও তার সহযোগীরা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে পুলিশের দাবি।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল স্বীকার করেছেন শাওনের সঙ্গে প্রতারণার কথা। পুলিশ অন্য অভিযোগগুলো যাচাইয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে। খোঁজা হচ্ছে তার সহযোগীদের।
আপনার মতামত লিখুন :