প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণ 


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ২০, ২০২২, ১২:৫৯ অপরাহ্ণ /
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণ 

বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়ে তাদের সার্বিক বিকাশ সাধন করে। বিদ্যালয় হলো একটি আর্দশ মানুষ তৈরির কারখানা। আর্দশ মানুষ তৈরির কারখানাকে আর্দশই হতে হয়। আর এউ আর্দশ মানুষ তৈরির কারিগর হলো বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা আর্দশ মানুষ তৈরি করে দেয়। তারপর তারা দেশ সেবার নিয়ে সেবায় লেগে পড়ে। যার সংস্পর্শে শিশুরা আর্দশ মানুষ হবে তাকেও অবশ্যই আর্দশবান হতে হবে। শিশুরা সব সময় শিক্ষককে অনুকরণ করে, শিক্ষকের কথা বলার ধরণ তার চাল-চলন, তার পোশাক-আশাক তার সব কিছু খেয়াল করে। তাই শিক্ষককে সবকিছু বুঝে আচরণ করতে হবে। শিক্ষককে সবকিছু বুঝে আচরণ করতে হবে। শিক্ষকের অবস্থান সবার উপরে প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের হতেখড়ি হয় শিক্ষকদের মাধ্যমে তার পর তাদের হাত ধরে বর্ন পরিচয় ঘটানো শব্দ তৈরী বাক্য তৈরি ধাপে ধাপে অগ্রসর করানো সবই শিক্ষককেই করতে হয়।

শিশুর অগ্রগতিতে বিদ্যালয়: শিশুর বিকাশ শুরু হয় বিদ্যালয় থেকেই। বিদ্যালয় থেকেই তার শারিরীক, মানসিক, সামাজিক, অধ্যাত্মক, নৈতিক, দেশাত্ববোধ, সহযোগিতা মনোভাব আদি গুনগুলো বিকশিত করার গুরুদায়িত্ব তুলে নেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। শিক্ষকরা শিশুদের নিরলসভাবে, অকাতরে জ্ঞান বিলিয়ে দেন। যদিও তাদের সাথে কোন রকম রক্তিম সম্পর্ক থাকে না তবুও তাদেরকে নিজের সন্তানের মত ছায়া দিয়ে আগলিয়ে রেখে মানুষের মত মানুষ তৈরি করেন নিঃস্বার্থভাবে। শিশুদের অগ্রগতিতে বিদ্যালয় তথা শিক্ষকের ভূমিকা কি তা তাদেরকে “করোনা পরিস্থিতি” চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। করোনা কালীন সময়ে শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে না পেরে পড়াশোনায় কি অবস্থা হয়েছে আমরা আজ শিক্ষক, অভিভাবক,শুশিল সমাজ, জনপ্রতিনিধি. সকলেই অনুধাবন করতে পারছি।

শিশুর অগ্রগতিতে শুশিল সমাজ ও স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ: বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হেতু সকলেরই দায়িত্ব হলো বিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। কিভাবে বিদ্যালয়কে আরো সুন্দরভাবে আরো উন্নত করা যায়। সবাইকে সহযোগীতা হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে সমাজের সমাজপতিরা চাইলে একটি বিদ্যালয়ের শিখন শেখানো কার্যক্রমসহ বিদ্যালয়ের যাবতীয় কর্মকান্ড সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে নানা কার্যক্রম গ্রহন করতে পারেন তন্মধ্যে

(ক) আমাদের দেশের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত তথা সচেতন নয়। তাঁরা কাঁদের সন্তানদেরকে বিদ্যালয়ে হয়তো বা ভর্তি করান কিন্তু সন্তান কি ঠিকমত বিদ্যালয়ে যায় কিনা বা নিয়মিত বিধ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করে কিনা, বিদ্যালয়ে পড়াগুলো বাড়িতে পড়ে কিনা সেগুলো ঠিকমত খোজ-খবর করেন না। সন্তান কি বিদ্যালয়ের নাম করে অন্য কোথাও গিয়ে সময় নষ্ট করে কিনা তা খোঁজ খবর করেন না।

 স্থানীয় বিদ্যানুরাগী ব্যর্ক্তিবর্গ অভিবাবকদের সাথে পথে-ঘাটে, মাঠে-প্রান্তরে, চলতে-ফিরতে দেখা হলে অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময় বা বাচ্চার পড়ালেখার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে পারেন বা তাদের বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে উদ্ভূত করতে পারেন।

(খ) বিদ্যালয় হলো পাঠশালা সেখানে গিয়ে শিক্ষার্র্থীরা তাদের বিকাশ সাধন করে পড়াশুনা করে। কিন্তু শিক্ষার্থীর যদি বিদ্যালয় যাওয়া ভিত্তি মাকে অর্থ্যাৎ তার যাতায়ত ব্যবস্থা যদি ভিত্তিহীন না হয় নিরাপদ না হয় তাহলে সে বিদ্যালয়ে যেতে চাইবে না। আর বিদ্যালয় না এলে সে তার বিকাশ সাধন করবে কি করে? তাই যোগাযোগের পথ সহজ তথা নিরাপদ করে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে তাদের শেখার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে পারেন।

(গ) শিশুদের মনে কোন ধরনের আশঙ্খা থাকলে তাদের শিখনে ঘাটতি পড়ে যায়। অনেক বিদ্যালয়ে শিশুদের তুলনায় তাদের বসার বেঞ্চের সংখ্যা কম অথবা পুরনো নড়বড়ে ভাঙ্গা যদি তাদের মনে কোন আশঙ্খা থাকে যে এই বেঞ্চের দ্বারা তার যেকোন সময় ক্ষতি সাধন হতে পারে, তাহলে তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবে ফলে শিক্ষন ঘাটতি হবে। স্থানীয়ভাবে যদি তার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তাদের শিক্ষন তরান্বিত হবে।

(ঘ) অনেক সময় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে নিয়মিত হয়না। কেন তারা বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসে না তার কারণ খুজে বের জন্য শিক্ষার্থী অভিভাবক ও শিক্ষকদের কথা বলা। সমস্যার সমাধান করা এবং শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে উদ্ভূত করা।

(ঙ) বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সমাবেশে উপস্থিত হয়ে (যেমন: অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক ইত্যাদি) অভিভাবকদের সমস্যার সমাধান করা। এতে করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং গ্রহণ যোগ্যতা বাড়বে । যার ফলে শিখনে অগ্রগতি হবে।

(চ) বিদ্যানুরাগী তথা সমাকেজর শুশিল ব্যক্তিবর্গ বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসলে শিক্ষদের সাথে মত বিনিময় করলে শিক্ষকদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। শিক্ষকদের খোঁজ- খবর নেয়া তাঁদের নভালো কাজের জন্য তাদের প্রসংশা করা হলে শিক্ষক মানসিক ভাবে উৎফুল্ল হবেন এবং পাঠদানে আরো বেশি মনোযোগী হবেন।

(ছ) শিক্ষক হলো জাতি তৈরির কারিগর। শিক্ষকদের সম্মানহানি হয় এমন কার্য থেকে বিরত থাকা। শিক্ষকদের সম্মানহানি কর কাজ করলে শিক্ষকদের দ্বারা ভালো আউটপুট পাওয়া সম্ভব নয়।

(জ) পাঠদান হলো বিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুপ্তর্পূন কাজ। তাই অযথা ক্লাসে প্রবেশ করলে সবার মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হবে ফলে শিখনে ঘাটতি থাকবে।

(ঝ) শিশুরা যেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে পারে সে ব্যবস্থা করা। যেমন: বার্ষিক ক্রিড়ানুষ্ঠান, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মূলক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন দিবসে অনুষ্ঠান করতে শিক্ষক মন্ডলীর সাথে যোগাযোগ করে তাদের সহযোগীতায় অনুষ্ঠান পালনে সহায়তা করা। বিদ্যালয়ে বাগান করতে সাহায্যে করা যাতে শিশুরা সেখানে অংশগ্রহন করে অর্থ্যাৎ পরিচর্যা করতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করে তাহলে শিশু মনে আনন্দের সঞ্চার হবে এবং শিখন তরান্বিত হবে। এভাবেই এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে সহযোগীতা করতে পারেন।

জনপ্রতিনিধির ভুমিকা: একটি বিদ্যাল সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য জন প্রতিনিধি ভূমিকা অপরিসীম। তিনি চাইলে একটি বিদ্যালয়ের মানের অনেক পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। তিনি যেহেতু জনগনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করনের দায়িত্ব প্রাপ্ত তাই তার ভূমিকা অপরিসীম। তিনি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো তথা আসবাসপত্র, রাস্তাঘাট, ব্রীজ-সাকো ইত্যাদি চাহিদা পূরন করে শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি তরান্বিত করতে পারেন। তিনি মাঝে মাঝে বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষকদের সাথে কথা বলে তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারেন। সেই সাথে শিক্ষকরা ঠিকমত বিদ্যালয়ে আগমন- প্রস্তান, পাঠদান করছেন কিনা তা নজরদারি করতে পারেন। তবে অযথা খবরদারি করলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। শিক্ষকদের স্বচ্ছতার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ গ্রহন করলে শিক্ষকরা রাজনৈতিক নেতার স্মরণাপন্ন হয় এবং অনেক সময় সঠিকতা যাচাই না করেই কর্তৃপক্ষের উপর খবরদারি করেন। ফলে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয় এবং শিখনের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ে। তাই রাজনৈতিক নেতাদের ভোটের স্বার্থ না দেখে যথার্থ বিবেচনা করা উচিত। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষেরও সহনশীল আচরণ করা উচিত।

শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করনে শুশিল সমাজ ও স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তি বর্গ: যে কোন কাজে স্বচ্ছতা থাকা অপরির্হায। স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা থাকলে কাজ গতি আসে। সবাই এর ফল ভোগ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের স্বচ্ছতা থাকলে কোমলমতি শিশুরা বেশি উপকৃত হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণে অনেক ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। তন্মধ্যে-

(ক) শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত মতবিনিময় করলে তাদের খোজ-খবর নিলে শিক্ষকরা কাজে উৎসাহ পাবেন।

(খ) কোন অভিভাবক যখন কোন ছাত্র/ছাত্রী পড়াশুনার বিষয়ে বিদ্যালয়ে এসে খোঁজ-খবর নেন তখন তার শিখন অগ্রগতি যাচাই করতে পারবেন। কোন সমস্যা থাকলে তা জানতে পারবেন।

(গ) বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকান্ড যেমন: বার্ষিক ক্রিড়া উৎসব, অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, পি.টি.এ সভা, এস.এস.সি সভায় উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশ নেয়া এবং সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে শিক্ষকদের সহায়তা দান করা।

(ঘ) শিক্ষকের উপর নজরদারি করা তারা ঠিকমত বিদ্যালয়ে আসেন কিনা বা নিয়মিত দেরিতে আগমন করা এবং সময়ের আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করা এসব হলে সেই শিক্ষকের বিষয়ে আলাদাভাবে প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করা। তবে অযথা বাইরে কোথাও কারো সাথে শিক্ষকের সমালোচনা ঠিক নয়। প্রয়োজনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা। তবে শিক্ষকের উপর খবরদারি করা, শিক্ষকের মান হারিকর কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে এই শিক্ষকের কাছ থেকেই তার সন্তান জ্ঞান অর্জন করবে।

বিদ্যালয়ের পরিবেশ যাতে ভিত্তিহীন, নির্যাতনহীন এবং শিখন ‍উপযোগী হয় তা আমাদের সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি বিদ্যালয়কে আর্দশ বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে পরি। সেখান থেকে প্রতি বছর শিক্ষার্থীরা আরো উন্নত শিক্ষার জন্য বেড়িয়ে যাবে। সে যেন বিদ্যালয়কে উন্নত করতে তথা পড়াশোনার মান বাড়াতে শুধুমাত্র শিক্ষকরাই ভূমিকা রাখতে পারে তা নয়। এখানে এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, শুশিল সমাজ, শিক্ষানুরাগী, জন প্রতিনিধি, অভিভাবক, শিক্ষার্থী সবার আলাদা- আলাদা ভূমিকা রয়েছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল হলো একটি আর্দশ বিদ্যালয়।

লেখক: মো: মাহবুব হাসান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জলঢাকা, নীলফামারী।

 

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com