বাংলাদেশের রাজনীতি এখন কোন পথে


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১৪, ২০২২, ৯:৪৪ অপরাহ্ণ /
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন কোন পথে

আহমদ সিরাজ : দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আয়তনে ছোট, তবে জনসংখ্যার হিসেবে বড়; বিষয় বৈচিত্র্যে মনোমুগ্ধকর- সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের বয়স বিবেচনায় একেবারে কম নয়- তাকে শিশুরাষ্ট্র বলা যাবে না। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিবেচনায় দেশের হিসাব বিস্তৃত ও গভীর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, কর্মকান্ড পরিচালনায় যদি বাংলাদেশকে বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই দেশ হিসেবে এ দেশটিকে এখনও একটা স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। দেশে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর সহনশীলবোধ নিয়ে গড়ে ওঠার সাংস্কৃতিক বোধ না থাকাতে দেশটির জন্মের পর থেকে সংঘাত আর সংঘাত চলতে থাকাতে ক্ষমতা ও ক্ষমতা বহির্ভূত প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে সন্দেহ অবিশ্বাস প্রবল আকার নিয়ে গড়ে ওঠে, তা নিরসনের কোনো আলামত দৃশ্যমান না হওয়ায় বরং সংঘাত ভয়ংকর রূপ নিয়ে এমনভাবে সমগ্র জাতিকে অক্টোপাসের মতো গ্রাস করেছে যে মানুষ এখন নিজেকে রাজনীতি বিমুখ জাতি হিসেবে গুটিয়ে নিচ্ছে, ক্রমশ এক ধরনের নির্লিপ্ত অবস্থান তৈরি হচ্ছে। রাজনীতি মানুষের জন্য যেন সেবা নয়। দেশপ্রেমের কথা সমাজনীতি-রাজনীতির ভাষায় বলা হলেও দেশ স্বাধীনের পর থেকে মাঠ-ঘাট এর রাজনীতির লীলা-খেলা দেখতে দেখতে মানুষের এখন আস্থাহীনতা, বিশ্বাসহীনতাই প্রবল হয়েছে এবং বুঝে নিয়েছে, ‘যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ’- এই লোক কথা দৃঢ় হয়েছে; জীবনের সর্বত্রই ঘুরে-ফিরে তাই থাকছে- বুঝি পার্থক্য বলতে তেমন কিছু নেই। যদি বলি তফাৎ কেবল উনিশ-বিশ, তা না হয় বাড়িয়ে বিশ-পঁচিশই করা গেল। দেশে আকাম-কুকাম যাই ঘটুক- তা পরিহার, প্রতিবাদে শক্তিশালী বিরোধী শক্তির অবস্থান নেই- যে শক্তি নিজেকে জাতির সামনে দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে উদ্ভাসিত করতে পারে। ফলে দেশ পরিচালনায় রাজনীতিতে অর্থের বিস্তৃতি এমনভাবে ঘটেছে যে, সততা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন এমন নাগরিক নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ চিহ্নিত হচ্ছে না। তিনি নাগরিক হিসেবে ফেরেসতা তুল্য হলেও নির্বাচনের জন্য অপ্রয়োজনীয়, অপাংক্তেয় হয়ে উঠেন। রাজনীতিতে গণতন্ত্র নয়, গণতান্ত্রিক মতামত জবাবদিহিতা নয়- দল পরিচালনায় দলের ভিতরে যার অর্থ ও দাপট সমানতালে থাকবে- দল তার পকেটে থাকবে। অর্থশক্তির বিবেচনায় ব্যক্তির জনপ্রিয়তা নয়, গ্রহণযোগ্যতা নির্ণীত হবে। এভাবে আমাদের চলমান বাস্তবতায় গড়ে ওঠা লুটেরা বুর্জোয়া দলগুলোর রাজনীতি তৈরি হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা ও ক্ষমতা বহির্ভূত বুর্জোয়া দলগুলোতে একই হালচাল বিদ্যমান। তার প্রভাব জনজীবনে এমনভাবে যে, দেশ জাতি মানুষকে ভালোবাসে, নিয়ম-নীতি মেনে চলে, অনিয়ম-দুর্নীতির প্রশ্রয়ে তাড়িত হয় না, তেমন ব্যক্তি জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। চলতি নির্বাচন ব্যবস্থায় এসব ব্যক্তি প্রার্থী হওয়ার ভাবনা-চিন্তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে- এখন ক্রমশ উচ্চারিত হচ্ছে যে, এসব ভালো মানুষদের জন্য রাজনীতি নয়। সোজা কথায় পৃথিবীর সকল ভালো গুণ থাকলেও তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য প্রয়োজনীয় নন। সময় যত যাচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধও এমনভাবে হয়ে উঠেছে যে, জনমনে ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে, কোনো সত্যিকার দায়িত্বশীল সৎ ব্যক্তি রাজনীতির পথে যদি পা বাড়ায় তাহলে তিনি হন করুণার পাত্র- তার এ সাহসী পদক্ষেপের জন্য প্রশংসিত না হয়ে বরং কথা উঠবে এমনসব মানুষের রাজনীতিতে আসতে নেই- বিষয়বস্তু এখন এমন হয়ে উঠেছে- রাজনীতিতে কোনো যোগ্য ভালো মানুষ যতই পছন্দের হউক- গৃহীত নন। অথচ রাজনীতির হিসাব হচ্ছে, যে সমাজ বা রাষ্ট্রে ত্যাগী মানুষেরা দেশ পরিচালনায় থাকে, সেই সমাজ বা রাষ্ট্র জনকল্যাণধর্মী হয়। কিন্তু আমাদের তো এরূপ অবস্থা-ব্যবস্থায় সক্ষমতা হারাচ্ছে। বেশি দূরে না গিয়ে কেবল রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য পাকিস্তান আমলে এদেশের মানুষ লড়াই সংগ্রাম করে যে রক্ত দিয়েছে তার ভিতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ত্রিশলক্ষ মানুষের আত্মাহুতি, দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত হারানোসহ সহায় সম্পদহীনতার পুরো স্বাধীনতার ৪৫ বছর ধরে আমাদের উন্নয়নে গণতন্ত্রের হিসাব নেই, উন্নয়নের হিসাবে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের হিসাব নেই- যুক্ত হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সাম্প্রদায়িকতা, লুটপাট ও সাম্রাজ্যবাদ তথা বিশ্বায়নকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, খোলাবাজার ব্যবস্থা এমনভাবে খুলে আছে, তাতে সর্বত্র ঘুষ দুর্নীতিতে মানুষের ‘ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা’- নাগরিকের কোনো কাজ আদায়ে ঘুষ দুর্নীতির বাইরে অবস্থান নেয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। মনে হয় লুটপাটে ভয়ংকরভাবে জড়িয়ে পড়া লুটেরা রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক রাজনীতি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল চেতনায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, যার ফলে লুটপাট কেন্দ্রিক অর্থনীতির ঘণিভূত প্রকাশ হয়ে উঠছে রুগ্ন রাজনীতি আর এই রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতে দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির একটা অংশ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রভাবক শক্তি হয়ে বাংলাদেশের মূল ধারাকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছে। ফলে শাসকগোষ্ঠীর কাছে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা আতংক হয়ে উঠেছে। এখন উন্নয়নের নামে যেন সব কিছু বাদ দিয়ে যেভাবে টিকে থাকা যায়- তাই গণতন্ত্রের নামে কথা বলা, প্রতিবাদ, সভা-সমাবেশে তোলপাড় নয়- উন্নয়ন। চোখের সামনে উদাহরণ আছে, সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে তাতে পুরো সুন্দরবন ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে, তা কোনো বিবেচনার নয়; বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হবেই। এদেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষায় পরীক্ষিত সংগঠন ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতা বহির্ভূত ক্ষমতাশীল দল বা দলের অংশ নয়। খাঁটি দেশপ্রেমের আবেগ ও বিশেষজ্ঞ অবস্থান থেকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করার জন্য বার বার তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে, কোনো কর্ণপাত নয়। তাদের কথা যে তুচ্ছ নয়- মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার সরকারের তা জানা থাকা সত্ত্বেও কেন যে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে আমলেই নিচ্ছেন না তা যুক্তিতে মিলে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হলে সরকার তেল গ্যাস জাতীয় কমিটিকে সানন্দে স্বাগত জানিয়ে হিসাব মিলিয়ে নিতে পারতেন। তাহলে কি আমাদের বুঝে নিতে হবে- রাজনীতি ও গণতন্ত্রের আতঙ্কের মতো রামপালে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টি যুক্ত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু নৃশংস হত্যায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এমন আতংকও আছে যে, সরকারের ভিতরে একটা দক্ষিণপন্থি শক্তি কালো চশমা পরে আছে কি না- যারা একটা দূরত্ব তৈরি করতে চায়। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কিংবা দেশের যে কোনো বিষয়ে দেশের নাগরিকের কোনো যৌক্তিক প্রশ্ন তোলা নাগরিক দায়িত্বের অংশ। এক্ষেত্রে কমিউনিস্ট বামপন্থিরা অণু-পরমাণুর অংশ হয়ে গেলেন কি না তা এই মুহূর্তে বিতর্কের বিষয় নয়। বরং তারা সরকারের বিবেচনায় অণু-পরমাণু হয়েও সুন্দরবন এলাকায় রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, কেবল প্রশ্ন তুলেই নয়, একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তাদের যৌক্তিক অবস্থান দ্বিধাহীনভাবে তুলে ধরেছেন এবং জাতির সামনে মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। তাদের এই অবস্থান দেশের সচেতন নাগরিকসহ সাধারণ মানুষের মাঝে বিবেচ্য হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপীও নাড়া পড়েছে। খোদ ইউনেসকো এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, এই ইস্যুটিকে সরকার হার-জিতের অংশ করে তোলার প্রবণতা। রামপাল আন্দোলন বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের কোনো আন্দোলন নয়- সুন্দরবন থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প জায়গায় সরিয়ে নেয়া। এখানে সরকারের হার জিতের বিষয় নয়। জানা থাকা ভালো পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ নিয়ে বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে হার-জিতের পরও পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস চুক্তি কিংবা অনেক ক্ষেত্রে ধ্বংসও করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে এসব আলামত আমাদের ভেবে নিতে হয়, সবকিছুর মূলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ- ৪র্থ স্তম্ভের বাংলাদেশ। তথা বাহাত্তরের সংবিধান। তার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে দেশ পরিচালনায় সক্ষম না হলে দুই অর্থনীতির বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটবে- যাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্নয়ন হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। আগামীদিনে একটা চূড়ান্ত ফয়সালার মধ্য দিয়ে তা চিহ্নিত হবে। লেখক: সদস্য, মৌলভীবাজার জেলা কমিটি, সিপিবি ।

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com