বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সম্ভাবনা


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২, ২০২২, ১১:৫৫ অপরাহ্ণ /
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সম্ভাবনা
অতি সম্প্রতি একটি বিষয় খুব জোড়েসোরে রব উঠেছে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মত অর্থনৈতিক দেউলিয়া হতে চলেছে বা পথে আছে কারণ চীনা বিনিয়োগের প্রতি অতি আকৃষ্টতা। কিন্ত গভীর ভাবে চিন্তা করলে এই বক্তব্য কতটুকু সঠিক না প্রোপাগান্ডা তা পাঠককূলের বুঝতে অসুবিধা হবেনা। বর্তমানে পৃথিবীর ৯৭টি দেশ চীনা ঋণ সুবিধাভোগী এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের চীনা ঋণ।

শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপটে চীনা ঋণ: শ্রীলঙ্কা উচ্চাভিলাসী ও অপরিকল্পিত ভাবে চীনা ঋণে প্রকল্প গ্রহণ শ্রীলঙ্কার গলার কাঁটা হয়েছে। বিশেষ করে হাম্বানটোটা বন্দর বন্দরটি নির্মাণের জন্য শ্রীলঙ্কা চীন থেকে ১৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু এই বন্দর থেকে যে আয় হয় তা ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে পরিচালনার জন্য চীন থেকে ২ শতাংশ সুদ হারে আরও ৭৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণ নেয়। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি, ২০১৪ সালে যখন বন্দরটি ঘাড়ের বোঝা হয়ে যাচ্ছিল তখন শ্রীলঙ্কা চীনের কাছে বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয়। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, বন্দরটি থেকে শ্রীলঙ্কা লাভবান হতে পারেনি তাদের নীতিগত ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। যদি বন্দরটি এমন হতো যে, এখান থেকে লাভবান হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই তাহলে কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানটি আগ্রহ দেখাত না এবং চীনও এই বন্দরটি লিজ ও নিত না। হাম্বানটোটা বন্দরের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সমর কৌশলগত গুরুত্ব স্বীকৃত। ফলে লাভবান হওয়ার মতো প্রকল্প থেকে নীতিগত ভুলের কারণে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চীনা ঋণের ওপরে দায় চাপানো কতটা যৌক্তিক? এর পরে চীনা ঋণে আরেকটি বড় অপরিকল্পিত প্রকল্প হচ্ছে মাত্তালা রাজাপাকসে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেটি এখন পরিত্যক্ত।
যেখানে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়লিয়ার পেছনে চীনা ঋণকে দোষারোপ করা হলে ধ্রুব সত্য হল শ্রীলঙ্কার ঋণের হার জিডিপির ১১৯ শতাংশ। দেশটির বেশি ঋণ নিয়েছে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের মাধ্যমে প্রায় ৪০ শতাংশ। এরপর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। জাপানের কাছ থেকে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং চীনের কাছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। তথা চীনের ঋণ কম।
বর্তমানে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তা হঠাৎ করে একদিনে হয়নি। গত এক দশক ধরে বিভিন্ন কারণে শ্রীলঙ্কা বর্তমান পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার আয়ের উৎসগুলো হচ্ছে তৈরি পোশাক, চা, রাবার ও পর্যটন। দেশটিতে গত শতকের ৮০’র দশকে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তার অভাবে তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশে চলে আসে। তারপর থেকে দেশটি পোশাক শিল্পে আর উন্নতি করতে পারেনি।
পরবর্তীতে দেশটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছিল চা, রাবার ও পর্যটন শিল্প। কিন্তু কৃষিতে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকার হঠাৎ করে শ্রীলঙ্কায় জৈব কৃষির উন্নয়নের ঘোষণা দিয়ে রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করে দেয়। যার ফলে কৃষি উৎপাদনে যেমন খরা লাগে তেমনি চা উৎপাদনও কমে আসে। এমনকি জৈব কৃষির যে পরিমাণ খরচ তা এই ব্যবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন লাভবান হয়নি। এর ফলে ধানের উৎপাদনও কমে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবল সংকটের মধ্যেও প্রধান খাদ্য চাল আমদানি করতে বাধ্য হয়। এই চাপ সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নজিরবিহীন পরিমাণে ঋণ নেয়।
একই সাল ২০১৯ এ দেশটির তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় বোমা হামলা ২৫৩ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এরপরই দেশটিতে নিরাপত্তার অভাবে পর্যটক যাওয়া কমে যায়। দেশটির মোট দেশজ আয়ে পর্যটন খাতের অবদান ১০ শতাংশ। পতনপর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির জন্য এই ১০ শতাংশ আয় হ্রাস মানে বড় ধরনের ধস। তাই শ্রীলঙ্কার দেউলিয়ার পেছনে কোনভাবেই চীনা ঋণ একক দায়ী না।
পাকিস্তানে চীনা ঋণ: চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) অধীনে ঋণ হিসেবে পাকিস্তান চীন থেকে ১৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করে। উল্লেখ্য পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋণ ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাপানকে অতিক্রম করে চীনই এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা।
সিপিইসির অধীনে পাকিস্তানের জ্বালানিখাতসহ ১৯টি প্রজেক্টে বিনিয়োগ করেছে চীন। এ বিনিয়োগটি বার্ষিক ৭ শতাংশ সুদসহ ২৫ থেকে ৪০ বছরে পরিশোধযোগ্য। অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী ৪৩ বছর প্রতিমাসে আনুমানিক ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে পাকিস্তানকে যা পাকিস্তান কিভাবে সামলায় সেটা দেখার বিষয়।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার বলে রাখা প্রয়োজন শ্রীলঙ্কার মত পাকিস্তানে ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অপরিকল্পিত ও উচ্চভিলাসী চীনা ঋণে প্রকল্প গ্রহণ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম বাঁধা যার সাথে কোনভাবেই বাংলাদেশকে মেলানো যাবেনা। ৯৭টি দেশ চীনের ঋণ সুবিধা গ্রহণ করলেও বিপাকে দুইটি দেশ কারণ তাদের অপরিকল্পিত, উচ্চাভিলাসী ও বাস্তবতা বিবর্জিত ঋণ গ্রহণ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চীনা ঋণ: পৃথিবীর ৯৭টি দেশ চীনা ঋণ গ্রহণ করলেও শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে নিয়ে বেশি আলোচনা শোনা যাচ্ছে এবং সেই জুজুর ভয় বাংলাদেশকে দেখাচ্ছেন কিছু বুদ্ধিজীবী, অর্থনৈতিক পরামর্শক থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও মহল।
শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে চীনা ঋণ ও বাংলাদেশকে একই সূত্রে গাঁথা ঠিক হবেনা। বাংলাদেশে চীনা ঋণে নির্মিত ও নির্মীয়মাণ প্রকল্পগুলোতে সরকারের মুন্সিয়ানার পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। চীনা বিনিয়োগ ব্যবহারে বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট সতর্ক এবং অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হবে এমন কোন প্রকল্প গ্রহণে এখনও পর্যন্ত সরকারকে দেখা যায়নি।
২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়। এসব প্রকল্পে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। তার মধ্যে অন্যতম ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প’।
উল্লেখ্য, ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সরকার একতরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় শীতের আগেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়। আবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিস্তার বাম তীরের জেলা লালমনিরহাট। এছাড়াও নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের সরাসরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিস্তার জন্য। প্রতিবছর ক্ষতি হয় কয়েকশত কোটি টাকা।
‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পে’ থাকছে তিস্তার নদী খনন, নদীর দুই পাড়ে তীর রক্ষাকাজ, চর খনন, স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ এবং বাড়িঘর রক্ষায় টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ।
এছাড়াও বাংলাদেশে বাস্তবায়িত ও বাস্তবানাধীন চীনা প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চীনা সরকার চায়না এইড কাঠামোর আওতায় বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে আটটি সেতু। বুড়িগঙ্গা নদীর উপর প্রথম বাংলাদেশ- চীন মৈত্রী সেতু বুড়িগঙ্গা সেতু, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর দ্বিতীয় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, চাপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর উপর তৃতীয় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, পঞ্চাগড়ের করতোয়া নদীর উপর চতুর্থ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, ঝালকাঠির গাবখান চ্যানেলের উপর পঞম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, ঢাকার মুন্সিগঞ্জের সাথে ধলেশ্বরি নদীর উপর ঢাকাকে যুক্ত করেছে মুক্তারপুর সেতু যা ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, মাদারীপুরে আড়িয়াল খাঁ নদীর উপর সপ্তম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু এবং পিরোজপুরের কচা নদীর উপর নির্মিত হয়েছে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। এই সেতুগুলো একদিকে যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ কানেক্টিভিটিকে সহজ করেছে অন্যদিক দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে গতিশীল করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে চীনা অর্থায়নে কক্সবাজার এর সাথে চট্টগ্রাম এর যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন করতে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। ৩ হাজার ৪০০ মিটার দীর্ঘ টানেলটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। প্রকল্পটিতে চীনা এক্সিম ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রায় ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা।
নিরবিচ্ছিন্ন ও স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে বিদ্যুত খাতে পটুয়াখালীর পায়রায় চীনের ১৬ হাজার কোটি টাকার ও বেশি বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। রাজধানী ঢাকায় ডিপিডিসির বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এতে একদিকে যেমন প্রতিদিন ঢাকাতে সৃষ্টি হওয়া টনকে টন বর্জ্য অপসারণ হবে অন্যদিক মেগাসিটি ঢাকার বৈদ্যুতিক চাহিদার অনেকাংশে পূরণ হবে।
এছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে চীনের অর্থায়ন রয়েছে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল হয়ে নবীনগর মোড় এবং ইপিজেড হয়ে চন্দ্রা মোড় পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে। ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ র‌্যাম্প থাকবে এই প্রকল্পে। উড়াল সড়কের উভয় পাশে চার লেইনের ১৪ দশমিক ২৮ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক হবে। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে ঢাকায় প্রবেশ বহিরগমণে ঘন্টার পর ঘন্টার জ্যামের অবসান ঘটবে, বাঁচবে মানুষের কর্ম ঘন্টা।
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের বিষয়ে কমনওয়েলথ সচিবালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. এমএ রাজ্জাক বলেন, চীন নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রায় ৭৫টি দেশে বিনিয়োগ করছে। প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব সুফল আদায় করতে চাইবে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা এবং বাংলাদেশ যাতে ঋণের ফাঁদে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখেই সব সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। কারণ বাংলাদেশে চীনের প্রতিশ্রুতি বেশি থাকলেও বিনিয়োগ বেশি ভিয়েতনামে। আবার চীনের এ বিনিয়োগ দেশে আনতে না পারলে সেগুলো মিয়ানমারে চলে যাবে। তখন বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতা পিছিয়ে যাবে
তবে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা বারবার বলেছেন, এখানকার পরিস্থিতি কোনোভাবেই শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের মতো হবে না। তাদের ভাষ্যমতে, দেশ দুটিকে এখনকার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে মোট বৈদেশিক ঋণের হার দেশ দুটির তুলনায় অনেক কম। এছাড়া প্রবাসীরাও দেশের অর্থনীতিতে প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, যা বাংলাদেশকে শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের মতো বড় সংকট থেকে সুরক্ষা দেবে। বাংলাদেশে এখন যেসব সংকট দেখা যাচ্ছে, তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চলমান সংকটের ধারাবাহিকতায়ই হচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে এসব সংকট কেটে যাবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক, উৎকণ্ঠার কিছু নেই। একই অভিমত অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদের। তারা দুজনই মনে করেন বাংলাদেশে এ মুহুর্তে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক বেশি দরকার। বিনিয়োগে এগিয়ে আসা সব দেশকেই বাংলাদেশ স্বাগত জানাচ্ছে। নিজের স্বার্থরক্ষা করেই তা করছে। উৎকণ্ঠার কারণ নেই। বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নকে ধরে রাখতে এবং এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ঋণ বা অনুদান হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যান মতে, ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত ঢাকাকে ঋণ, অনুদান বা অর্থসহায়তা হিসেবে প্রায় ৩২১ কোটি ডলার দিয়েছে বেইজিং।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি শ্রীলঙ্কার মত হবে এ বিষয়ে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ (ইআরডি) সংশ্লিষ্টদের মূল্যায়ন যে কোনো প্রকল্পের আউটকাম তথা রিটার্নের বিষয়টি মাথায় রেখেই সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের মতে কোনো একটি দেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাতের ২০ শতাংশকে আদর্শ ধরা হয়। সেদিক থেকে জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশের বর্তমান ঋণ ১৬ শতাংশ (যেখানে শ্রীলঙ্কার ছিল ৬১ শতাংশের ও বেশি)।সেটিও আবার স্বল্প সুদে (২ শতাংশের কম সুদে) চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ। এ কারণে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) দাবি, বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে- এটা ভুল ও কল্পনাপ্রসূত ধারণা।
সর্বোপরি, এখন পর্যন্ত সার্বিক বিষায়াদি বিবেচনা করলে দেখা যায়, সরকার যেসব প্রকল্পের জন্য চীন থেকে ঋণ সহায়তা গ্রহণ করেছে তা উচ্চ বিলাসী, অনুৎপাদনশীল ও অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক নয় বরঞ্চ সময়ের দাবীর প্রেক্ষাপটে সঠিক ও যুগোপোযগী। এই সকল ঋণ বাস্তবায়িত ও বাস্তবানাধীন প্রকল্প থেকে নির্ধারিত নির্দিষ্ট মেয়াদে পরিশোধ যোগ্য ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তথ্য সূত্রঃ বণিক বার্তা, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, জাগো নিউজ।
মীর দিনার হোসেন, সম্পাদক ও প্রকাশক বাংলাদেশ সকাল।
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com