
সাঈদের শিশুকাল থেকে কবরে দাফন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ সাক্ষী হব ভাবতেই পারছি না। লিখতেই শরীর শিউরে ওঠছে, বুকের ভিতর টা ধুমড়ে মুচড়ে পড়ছে। অভাবের সংসার সাঈদের। বাবা বর্গা চাষী অন্যের জমি চাষ করে। দিনমজুর করে দিনাতিপাত করত। পরিবারের অন্য ছেলে মেয়েরা অভাবের জন্য প্রাথমিক পার করতে পারেনি শুধু সাঈদের ইমিডিয়েট বড় ভাই আবু হোসেন এবং সকলের স্নেহের ছোট বোন সুমি এইচএসসি পাশ করেন।
এরপর সবার ছোট ছেলে আবু সাঈদের দিকে বাবা-মা ভাই বোন সবার নজর সাইদের পড়াশোনার দিকে। সে বড় হয়ে পড়াশোনা করে অনেক বড় অফিসার হয়ে বাবা মার মুখ উজ্জ্বল করবে।
ছোট বোনকে পড়াশোনা করাবে চাকরি করাবে এবং ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিবে।আমার মনে পরে; যখন সাঈদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে তখন থেকে সে তার বাবা এবং ভাইদের সাথে মাঠে কাজ করত। সকালে কাজ করে ৮/৯ টা বাজার সাথে সাথে বাড়িতে এসে স্কুলে যেত। স্কুল শেষে আবার সে মাঠে কাজ করতে যেত। কাজের কারণে সাঈদ বেশি খেলাধুলার সময় পেত না। এক পোশাকে ২/৩ বছর পার করত এভাবেই চলতে থাকে সাঈদের ছোট বেলা।
ছোট বেলা থেকে সাঈদ অনেক নম্র ও ভদ্র ছিল।৫ম শ্রেণিতে বৃত্তি পায় সাঈদ। ক্লাস সিক্স থেকে গ্রামে ১০০ টাকায় টিউশন করাত এই টাকা দিয়েই খাতা কলম কিনত ও পরীক্ষার ফি দিত। এভাবে এসএসসি সাফল্যের সাথে পাশ করে গ্রাম থেকে রংপুর শহরে রংপুর সরকারি কলেজ এ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
টাকার অভাবে পড়াশোনা প্রায় বন্ধের পথে! অনেক কষ্ট করে টিউশন ম্যানেজ করে। টিউশন করে নিজের সকল পড়া লেখার ব্যয় ভার বহন করার পাশাপাশি বাবা মাকে ও সহযোগিতা করত। এইচএসসি অনেক কষ্টে শেষ করে সাঈদ স্বপ্ন দেখে উচ্চ শিক্ষার, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো বিষয়ে ভর্তি হতে চায়। অনেক দিন আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরামর্শ নিয়েছে। যেহেতু আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। এসে বলত ভাই আমারা গরিব মানুষের ছোল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মানুষের মত মানুষ হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার থেকে সাঈদের স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। দেশের জন্য ভাল কিছু করার । সাঈদকে আমি আমার মেসেই ওঠায় নিজের ছোট ভাইয়ের মত সকল দিক নির্দেশনা দিয়েছি। সাঈদের সাথে আমার ৬ সেমিস্টারের পার্থক্য ছিল।এজন্য অনার্সের কোন বই সাঈদকে কিনতে হয়নি।
আমার বুক সেল্ফ-থেকে সাঈদ প্রত্যেক সেমিস্টারের বই নিয়ে যেত। সেমিস্টার শেষে আবার বই ফিরত দিয়ে পরবর্তী সেমিস্টারের বই নিয়ে যেত।মেসে সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করত হাসি খুনসুটি করেই সময় গুলো যাচ্ছিল। এগুলো ভাবতেই চোখের জল থামাতে পারছি না শুধু মন বলছে ভাই সাঈদ তুই কৈ গেলিরে ভাই, ভাই আয় তুই আমার কাছে বই নিবি না!
আয় ভাই- তুই না মাঝে মাঝে বলতি ভাই ৫০০ টাকা হবে চাল শেষ হয়েছে চাল নিবো; টিউশন শেষে টাকা দিব,ভাই সাঈদ তুই কৈ গেলি! তোকে বাঁচাতে পারলাম না। তুই সত্য ও ন্যায়ের পথে সব সময় ছিলি তোকে হারাবো ভাবতেই পারছি না।তুই কোন রাজনীতির সাথে ছিলি না। সাঈদ কোঁটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সকল ছাত্র ছাত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রতিবাদ করছিল। শান্তিপুর্ণ মিছিলে কিভাবে নির্দয় ঘাতক পুলিশ গুলি করে আমার ছোট ভাইকে হত্যা করলো।
সরকারের কাছে আমি হত্যার বিচার চাই। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে রংপুর মেডিকেল এ গিয়ে দেখি লাশ ঘরে সাঈদের দেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে। মেডিকেলের সকল কাজ শেষে শহিদ বীর সাঈদের লাশের পাশে বসে তার গ্রামের বাড়িতে রওনা দেই। পরের দিন সকাল ১০ টায় চিরনিদ্রায় তার বাড়ির পাশে সমাহিত করা হয় সাঈদকে।