জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিক হাসানুল হক ইনুর ৭৭তম জন্মদিন আগামীকাল মঙ্গলবার ১২ নভেম্বর ২০২৪। মা বেগম হাসনা হেনা ও বাবা এএইচএম কামরুল হকের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে প্রথম সন্তান হাসানুল হক ইনু জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১২ নভেম্বর নওগাঁয় নিজ নানাবাড়িতে। একটি নীতিনিষ্ঠ শিক্ষিত পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি বেড়ে ওঠেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলি পেপার মিল হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকার নটরডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় তিনি পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের একজন অ্যাথলেট ও ঢাকার প্রথম বিভাগের ফুটবল খেলোয়ার হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।
১৯৬৮ সালে তিনি ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফাকে স্বাধীনতার এক দফা আন্দোলনে পরিণতি দেয়ার উদ্যোগে যোগদান করেন ছাত্রলীগের একজন সদস্য হিসেবে। ১৯৬৯ সালে গলঅভ্যুত্থান সংঘটনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ও ছাত্রলীগের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। এসময় তিনি পেশা হিসেবে রাজনীতিকে বেছে নেন। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শহিদ সার্জেন্ট জহুরের স্মরণে ১৯৭০ সালে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের উদ্যোগে ছাত্রলীগ আয়োজিত ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে এই ‘ফেব্রয়ারি ১৫ বাহিনী’র নাম পাল্টে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ নামকরণ করে; ১৯৭০ সালের ৭ জুন ‘স্বাধীকার দিবস’ পালনকালে তিনি জয় বাংলা বাহিনীর সামরিক কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দিয়ে পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানান। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির অংশ হিসাবে ঢাকার সাইন্স ল্যাবরেটরি থেকে বিপুল পরিমান কেমিক্যাল সংগ্রহ করে বোমা তৈরি করেন যা ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসকে নাকচ করে ঘোষিত প্রতিরোধ দিবসে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পল্টনময়দানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ও ছাত্রনেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। এদিনই প্রথম সারা বাংলাদেশে একযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতের দেরাদুনের তান্দুয়ায় বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ক্যাম্প ইনচার্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ও দশ হাজার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দেন ।
দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে জাতীয় কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক কৃষি বিপ্লবের কর্মসূচি প্রণয়ন করে কৃষক লীগ সংগঠিত করা ও সারা দেশ ঘুরে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের সাথে রাজনৈতিক সাক্ষাত ও যোগাযোগের পর্যায়ে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাসদে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। দল নিষিদ্ধ হলে তিনি ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’র উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান, প্রধান হন কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে জাসদ-ইউপিপি- জাগমুই এর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগে যুক্ত হন। কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের সহযোগী হিসেবে তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মহান সিপাহি—জনতার অভ্যুত্থান সংগঠিত করেন। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার পর ২৩ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জিয়ার প্রহসনমুলক বিচারে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি, হাসানুল হক ইনুকে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেয়া হয়।
সাজা ভোগ করে ১৯৮০ সালের ১৩ জুন তিনি কারামুক্তি পান। জিয়ার কারাগার থেকে জাসদ নেতাদের মধ্যে সবার শেষে মুক্তি পেয়েই সারাদেশের নেতাকর্মীদের কাছে গিয়ে দেখা করেন ও ইতোমধ্যে জিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে গঠিত ১০ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে আন্দোলন সংগঠনে উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন। ১৯৮২ সালে এরশাদ সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও আওয়ামী লীগ সহ ১৫ দল গঠনে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৬ সালে জাসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৫ দল ভেঙে গেলে তিনি ৫ দল গঠন করেন। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটনে রাজপথের ট্যাকটিক্যাল নির্দেশনা ও ঐক্যের কৌশল প্রণয়নে তিনি অত্যন্ত মেধাবী রাজনীতিকের ভূমিকায় আসীন হন। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে খালেদা জিয়ার শাসনামলে তিনি বাম গণতান্ত্রিক জোট গটনে নেতৃত্ব দেন। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনে তিনি জাসদকে সক্রিয় ভুমিকায় অবতীর্ণ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ঐক্যবদ্ধ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে জাসদের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ২০০১ সাল থেকে শুরু করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রম করে ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোর জোট ১৪ দল গঠন করতে সক্ষম হন। দেশে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় তিনি অনতিবিলম্বে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে অবস্থান নেন ও জনমত গড়ে তোলেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি কুষ্টিয়া থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন ও এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থার রাজনীতির অবসান করতে তিনি ১৪ দলীয় জোটের অংশীদার হয়েও ১৪ দলের অভ্যন্তরেই ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্য নীতির ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দূর্নীতি-লুটপাট-বাজার সিন্ডিকেট দমনসহ জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও সংকট নিয়ে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি সংসদের ভিতরে ও বাইরে সমানভাবে সোচ্চার ছিলেন। তিনি কন্ঠস্বরহীনদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসাবে বরাবর ভূমিকা পালন করেছেন।
হাসানুল হক ইনু একজন পরিশীলিত সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিক হিসেবে, জোট গঠনের কৌশল প্রয়োগে ও রাজপথের আন্দোলনের ট্যাকটিকস প্রণয়নে একজন মেধাবী রাজনীতিক। তার প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও রাজনিতি বিষয়ক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশকে ইন্টারনেট অভিগম্যতা সংহত করতে তার রয়েছে ব্যাপকতর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
২০২৪ সালে জুলাই—আগস্ট কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের শুরুতেই তিনি কোটা সংস্কারের জন্য ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে কোটা সংস্কার কমিশন গঠন এবং ছাত্রদের উপর বলপ্রয়োগ না করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাতে থাকেন। ১৬ আগস্ট রংপুর ও ঢাকায় ছাত্রহত্যার ঘটনার পরও তিনি ছাত্র হত্যার বিচার এবং নিহত ছাত্রদের পরিবার থেকে একজন করে সদস্যকে সরকারী চাকুরি প্রদান করাসহ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। তিনি সংঘাত-সংঘর্ষের প্রাণহানির ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি ক্রমাগত আহবান জানানো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তণের পর ২৬ আগস্ট ২০২৪ তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে আইনী যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া ৪০টি হয়রানিমূলক মিথ্যা হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতার করার পর তাকে কয়েকবার রিমান্ডে আনা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গনে পুলিশ-সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা বেস্টনির মধ্যেই তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করা হয়েছে। আদালতে তার আইনজীবীদের লাঞ্চিত করা এবং আর্জি পেশে বাধা প্রদান করা হয়েছে।
দেশের এই প্রখ্যাত ও প্রবীন রাজনীতিক, জাতীয় নেতা হাসানুল হক ইনুর ৭৭তম জন্মদিন কেরানিগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই সহকারাবন্দির সাথে কাটবে।
আপনার মতামত লিখুন :