মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম—
সংসার সাগরে সুখ-দুঃখ তরঙ্গের খেলা
আশা তার একমাত্র ভেলা।
জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য মানুষ নানা পেশাতে জড়িত হয়। জীবন যাপনের জন্য তো যোগ্যতা অনুযায়ী একটা না একটা পেশাকে বেছে নিতেই হবে। চার সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত দৈনিক পত্রিকার হকার শাহ আলমের সংসার। স্ত্রী ও দুই ছেলে আব্দুল্লাহ এবং আদনান। আব্দুল্লাহকে প্রতিবন্ধীই ধরা যায়। কারণ, জন্মের পর থেকেই সে স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না। ইতোমধ্যে তাকে স্কুলেও ভর্তি করানো হয়েছে। আদনানের স্কুলে যাওয়ার বয়স এখনো হয়নি। শাহ আলম কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দুলালপুর গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার সোবহান টেইলারের বাড়ির মমতাজ উদ্দীনের ছেলে। বাবা জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০০১ সালে মারা যায়। তার মা দীর্ঘ অনেক বছর যাবৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। মার চিকিৎসা করতে যেয়ে তাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিলো। তারপরও শেষ চেষ্টা করতে পিছপা হয়নি। সেজন্য তাকে দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক ঋণের ঘানি টানতে হচ্ছে।
নামাজী ছেলে শাহ আলম। ফজরের নামাজ শেষ করেই বাই সাইকেলে চড়ে গ্রামের বাড়ি থেকে দেবিদ্বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। দুলালপুর থেকে দেবিদ্বারের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সে দেবিদ্বার এসে নিউমার্কেট বাস স্টেশনে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে থাকে পত্রিকার জন্য। কুমিল্লা থেকে বাসে পত্রিকা আসে দেবিদ্বার। কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়েতো আর পত্রিকা পৌঁছে না। কোনো কোনো দিন তাকে পত্রিকার জন্য ২-১ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। আমি সাধারণত শুক্র ও শনিবার আমার বাসা মাশিকাড়া থেকে ৪০ টাকা করে ভাড়া দিয়ে দেবিদ্বার থেকে পত্রিকা নিতে আসি। বাকী দিনগুলোতে স্কুলের পাশের এক অটো চালককে মাসে ১৫০ টাকা দিয়ে পত্রিকা এনে পড়ি। প্রতি মাসে দু এক দিন বিশেষ করে শুক্রবারে শাহ আলমের সাথে দেখা হয়। তার সাথে দেখা হলে সে বলে স্যার কিছু টাকা থাকলে দেন, নাস্তা খাবো। আমার সাথে টাকা থাকলে কোনো দিন ২০-৩০ টাকা দেই। খুবই খুশি হয়। এটাও বলে স্যার কষ্ট পেয়েছেন? আমি বলি না, তোমাকে যে কয়টি টাকা দিতে পেরেছি এটা আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। আমার কাছে এটা আনন্দের বিষয়। আমি তো নির্ধারিত বেতনের চাকরি করি। আর মাস শেষ হলে তো পকেট প্রায় খালিই থাকে। ইচ্ছা থাকলেও তোমাকে বেশি টাকা দিতে পারছি না। মাঝে মাধ্যে সুযোগ পেলে তার কাছ থেকে তার পরিবারের খোঁজ খবর নেই। জানতে চাই পরিবারের হাল হকিকত। সে বলতে চায় না। সে বলে, আপনি তো আর আমাকে বড় কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন না।
শাহ আলমের পত্রিকা বিলি শুরু হয় সকাল ৭-৮টা থেকে। বাই সাইকেলে চড়ে সে পুরো পৌরসভা ঘুরে বেড়ায়। গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তার সাথে দেখা হলে সে বলে, বাই সাইকেল দিয়ে পত্রিকা বিলি করতে তার নাকি খুবই কষ্ট হয়। তার কথা আমার যদি একটি মটর সাইকেলের ব্যবস্থা হতো কতই না ভালো হতো। দৃষ্টি আকর্ষণঃ দেশের সম্পদশালী এবং হৃদয়বান ব্যক্তিদের নিকট তার পক্ষ থেকে আমার আকুল আবেদন যাদেরকে আল্লাহ বিত্ত এবং চিত্ত দিয়েছেন এমন একজন ব্যক্তি তাকে একটি মটর সাইকেল কিনে দিয়ে তার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসুন।
বিকাল ২-৩ টা বেজে যায় তার বাড়ি পৌঁছতে। ১০ বছর যাবৎ এভাবেই চলছে শাহ আলমের হকার জীবন। ঝড়-বৃষ্টির দিনে তো তার কষ্টের কোনো সীমাই থাকে না।যারা নিয়মিত পত্রিকা পড়েন তাদের থেকে মাস শেষ হলে শাহ আলম টাকা নিতে আসে। কিন্তু অনেকেই সময় মতো পত্রিকার বিল পরিশোধ করেন না। সে বলেছে- এখনো অনেকের কাছেই পত্রিকার বিল পাওনা আছে। যারা পত্রিকা পড়ুয়া পাগল তাদেরকে তো একদিন পত্রিকা না দিলে ফোনে ধমকি ধামকি শুরু হয়ে যায়। আমি নিজেও একদিন পত্রিকা না পেলে তাকে ফোন দেই। কেনো পত্রিকা দেওনি? সে বলে, স্যার মাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা গিয়েছিলাম, তাই পত্রিকা দিতে পারিনি। তার কাছ থেকে জানতে পারি দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ সে তার মাকে নিয়ে প্রতিমাসে একবার ঢাকা যেতো ডাক্তার দেখাতে। যারা শাহ আলমের কাছ থেকে নিয়মিত পত্রিকা কিনেন, তার পক্ষ থেকে আমার একটি মানবিক আবেদন এখন থেকে নিয়মিত পত্রিকার বিল পরিশোধ করবেন। সম্ভব হলে মাস শেষে তাকে পত্রিকার মূল্যের সাথে অতিরিক্ত ২০-৩০ টাকা দেবেন। আর দুটি ঈদেও তাকে অতিরিক্ত ৫০-১০০ টাকা করে দিলে সে পরিবার পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে ঈদ করতে পারবে।
পত্রিকা পড়া আমার নেশা। কোনো একদিন পত্রিকা না পেলে আমার ভালো লাগে না। যেহেতু লেখা লেখির সাথে জড়িত আছি তাই পত্রিকা পড়তেই হয়। ইতিপূর্বে দেবিদ্বারে তিন চার জন হকার ছিলো। এখন মাত্র একজন আছে। জানিনা কোন দিন শাহ আলমেরও পত্রিকার হকারি বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকা হচ্ছে জ্ঞানের ভান্ডার। বলুন কি নাই পত্রিকাতে? একজন শিক্ষার্থী যদি নবম শ্রেণি থেকে যে কোন একটি জাতীয় পত্রিকা নিয়মিত অধ্যয়ণ করে আমি ঈযধষষবহমব দিয়ে বলতে পারি সে বি.সি.এস. সহ জীবন যুদ্ধে কখনো কোথাও পরাজিত হবে না। তাই সন্তানদের স্বার্থে আপনি একজন দায়িত্বশীল পিতা-মাতা হিসেবে নিয়মিত পত্রিকা পড়ুন। এদিকে পত্রিকা পড়ার পর আবার হোটেলগুলোতে ভালো দামে বিক্রিও করা যায়। আপনি তিন মাসের পত্রিকা বিক্রি করে এক মাসের পত্রিকার বিলও পরিশোধ করতে পারবেন। পত্রিকার হকাররা পত্রিকা বিক্রি করে আমাদের সমাজের মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করে। মানুষকে সমাজ সচেতনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখার সুযোগ করে দেয়। মোবাইলের সুবাদে অনেক জায়গায় পত্রিকা বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক বছর পূর্বে আমাদের দেবিদ্বারে প্রতিদিন কয়েক হাজার কপি পত্রিকা বিক্রি হতো। এখন ৩০০-৩৫০ কপির মতো পত্রিকা বিক্রি হয়। ইতোমধ্যে সারা দেশের কয়েক হাজার হকার পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। শাহ আলম পৃথিবীর সমস্ত খবরা-খবরের কাগজ বিভিন্ন ধরণের দৈনিক পত্রিকা নিয়ে প্রতিদিন সকাল বেলা আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। দেশ ও জাতি গঠনে তার অবদান কোনো অংশেই কম নয়। তাই আমাদের উচিত তাকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে দেবিদ্বারে পত্রিকা পড়ার সুযোগ চালু রাখা। তার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করা।
লৈখক : মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম(বি এস এস, বি এড)সহকারি প্রধান শিক্ষকমাশিকাড়া উচ্চ বিদ্যালয় দেবিদ্বার কুমিল্লা
বাংলাদেশ।
আপনার মতামত লিখুন :