
আতিকুর রহমান, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
একদিকে বাবার ভাঙা পা, অন্যদিকে মায়ের অসুস্থতা—চলাফেরা তো দূরের কথা, নিজে হাতে খাবারও খেতে পারেন না নুরুন্নবী ইসলাম আপন। এমন একটি পরিবারে কাঁধে সংসারের দায়িত্ব নিয়েই ২০২৫ সালের এসএসসি (কারিগরি) পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলায় শীর্ষস্থান অর্জন করেছেন তিনি। ২৬০০ নম্বরের মধ্যে ২৩৩০ পেয়ে নজর কাড়েন আপন।
আপনের বাড়ি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় ইউনিয়নে। তিনি নাগেশ্বরী সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ অর্জন। অথচ এত বড় সাফল্যের পরও তার উচ্চশিক্ষা নিয়েই অনিশ্চয়তা রয়েছে।
আপনের বাবা বাচ্চু মিয়া স্থানীয় একটি ছ’মিলে কাজ করতেন। প্রায় ৯ মাস আগে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় পড়ে তার একটি পা ভেঙে যায়। বর্তমানে তিনি অচল। মা নুরজাহান বেগম দুই বছর ধরে শয্যাশায়ী। এই অবস্থায় সংসার চালানোর দায়িত্ব এসেছে পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য, আপনের কাঁধে।
অষ্টম শ্রেণি থেকেই টিউশন করতে শুরু করেন আপন। এখন দিনে তিনটি টিউশন করে যা আয় করেন, তাতেই চলে সংসারের খরচ, ওষুধপত্র এবং নিজের লেখাপড়া।
আপন বলেন, “আব্বুর পা ভাঙার পর বুঝেছি, আমি আর শুধু ছাত্র না, এই সংসারের দায়িত্বও আমার। আমি চাই একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হতে। মা-বাবাকে ভালোভাবে দেখতে চাই, দেশের জন্য কিছু করতে চাই। কিন্তু রংপুর বা ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনার সামর্থ্য নেই। টিউশনের আয়ে কোনোমতে সংসার চলে।”
সহপাঠীরা জানায়, আপন সবসময় মেধাবী ছিলেন। তবে কঠিন বাস্তবতা কারও কাছে প্রকাশ করতেন না, নীরবে নিজের কাজ চালিয়ে যেতেন।
নাগেশ্বরী সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাডেমিক ইনচার্জ শামীম আজম বলেন, “আপনের ফলাফল আমাদের গর্বিত করেছে। সরকার ও সমাজের উচিত এমন শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো, যাতে তার মেধা নষ্ট না হয়।”
আপনের পরিবারে তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। দুই বোনই অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা নিতে পারেননি। একজন দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন ঝরে পড়েন, অন্যজন এসএসসি পাশ করার পর বিয়ে করেছেন।
আপনের মা বলেন, “আমার ছেলে না থাকলে আমরা বেঁচে থাকতাম না। ও নিজের কষ্ট লুকিয়ে আমাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। এই সাফল্য শুধু ওর না, আল্লাহর রহমত।”
বিজ্ঞানের প্রতি রয়েছে আপনার আলাদা আগ্রহ। টানা দুই বছর উপজেলা পর্যায়ে বিজ্ঞান মেলায় সেরা হয়েছেন তিনি। পুরস্কার তুলে দিয়েছেন ইউএনও নিজেই। তবে কোচিং কিংবা বাড়তি প্রস্তুতির কোনো সুযোগ পাননি, কারণ টিউশনের আয়ে সেই খরচ বহন করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, এবছর কুড়িগ্রাম জেলায় এসএসসি (কারিগরি বোর্ড) পরীক্ষায় প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে নাগেশ্বরী উপজেলায় ১০১ জন এবং কুড়িগ্রাম সদরে ২৭৯ জন। সব পরীক্ষার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন নুরুন্নবী ইসলাম আপন—২৩৩০।