বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের প্রাথমিক স্তরে গ্রাম আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের প্রায় ৬৮% মানুষ গ্রামে বসবাস করে (বিবিএস, ২০২৪), তাই তাদের ন্যায়বিচারের সুযোগ, স্থানীয় দ্বন্দ্ব সমাধান এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গ্রাম আদালত অপরিহার্য। ১৯৩৬ সালের গ্রাম আদালত অধ্যাদেশের উত্তরাধিকার হিসেবে ২০০৬ সালে প্রণীত গ্রাম আদালত আইন এ স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি কাঠামো তৈরি করা হয়। তবে বাস্তবে কাঙ্ক্ষিত সুফল এখনও পুরোপুরি অর্জিত হয়নি।
গ্রাম আদালতের কাঠামো ও এখতিয়ার
গঠন: আইন ২০০৬ এর ৫(১) ধারা অনুযায়ী, চেয়ারম্যান ও উভয় পক্ষের নির্বাচিত দুজন সদস্যসহ মোট ৫ সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত।
ক্ষমতা: মামলা দায়ের, সমন ইস্যু, সাক্ষী পরীক্ষা, লিখিত রায় প্রদান।
আর্থিক এখতিয়ার: আইন ২০০৬ এর ৭ ধারা অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা আরোপের ক্ষমতা।
পরিসর: সম্পত্তি, পারিবারিক বিরোধ ও ছোটখাটো দেওয়ানি-ফৌজদারি মামলা।
বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ
১. রাজনৈতিক প্রভাব: ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত হওয়ায় নিরপেক্ষ বিচার বিঘ্নিত হয়।
২. সীমিত ক্ষমতা: জটিল মামলার এখতিয়ার না থাকায় মানুষ অনেক সময় আদালতে যেতে আগ্রহী হয় না।
৩. অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যাতায়াত, তথ্য ও আইনি সহায়তা ঘাটতি।
৪. আইনগত অসামঞ্জস্য: গ্রাম আদালত আইন (২০০৬) এবং পারিবারিক সহিংসতা আইন (২০১০) এর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নেই।
5. সচেতনতার অভাব: অনেক মানুষ এখনও মনে করে নির্বাহী বিভাগই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
6. স্বচ্ছতার অভাব: শুনানি স্থগিতকরণ, পক্ষপাতিত্ব ও দীর্ঘসূত্রিতা।
সংবিধানগত প্রেক্ষাপট
অনুচ্ছেদ ১৬: শহর ও গ্রামের জীবনমানের বৈষম্য দূরীকরণ।
অনুচ্ছেদ ২২: নির্বাহী ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ।
অনুচ্ছেদ ৩৫: দ্রুত, ন্যায়সঙ্গত ও প্রকাশ্য বিচারের অধিকার।
তবে বাস্তবে এসব সাংবিধানিক নিশ্চয়তা গ্রামীণ স্তরে প্রতিফলিত হয় না।
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
১. আইন সংশোধন: চেয়ারম্যান রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হলে নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়, তাই বিচারকদের স্বতন্ত্রতা নিশ্চিত করতে আইন সংস্কার জরুরি।
২. প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি: স্থানীয় সালিশকারী ও সদস্যদের পেশাদার প্রশিক্ষণ দেওয়া।
৩. আইনি সচেতনতা বৃদ্ধি: কর্মশালা, প্রচারণা, আইনি সাক্ষরতা কার্যক্রম।
৪. সংহতকরণ: গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক আদালতের সাথে সমন্বিত ও বাস্তবায়নযোগ্য করতে হবে।
৫. অর্থ বরাদ্দ: অবকাঠামো, প্রশাসনিক সহায়তা ও টেকসই বাজেট নিশ্চিত করা।
৬. পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা: জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে নিয়মিত মূল্যায়ন ব্যবস্থা গঠন।
গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করা কেবল একটি আইনি সংস্কারের প্রশ্ন নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচার ও তৃণমূল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মৌলিক প্রয়োজন। গ্রামীণ মানুষের সাশ্রয়ী, দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গত বিচার প্রাপ্তির জন্য আইন সংশোধন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কাঠামো, পর্যাপ্ত বাজেট ও জনগণের সচেতনতা অপরিহার্য।
সুতরাং, গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজে ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করা আজকের সময়ের দাবি।
লেখক:গোলাম মোস্তফা বাদশা
শিক্ষার্থী, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক
আপনার মতামত লিখুন :