হাসি-কান্নার একটি নাম, কুমার নদ


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২, ২০২১, ৯:৫৬ অপরাহ্ণ / ০ Views
হাসি-কান্নার একটি নাম, কুমার নদ

ফরিদপুরের মানুষের জীবনযাত্রা হাসি-কান্নার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে আছে একটি নাম, কুমার নদ। জেলার প্রতিটি উপজেলার পরতে পরতে রয়েছে কুমারের ছোঁয়া। এ নদকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ফরিদপুরের বিভিন্ন জায়গার জনবসতি। এ নদই মানুষকে দিয়েছে জীবন ও জীবিকার আশ্রয়।

কুমার নদ পদ্মারই একটি শাখা। শহর থেকে খানিক দূরে সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নের মদনখালী থেকে জন্ম এ নদের। সেখান থেকে শহরতলির অম্বিকাপুর শ্মশানঘাট এলাকায় এসে নদটি দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। এ দুটি ধারার প্রথমটি কুমার এবং দ্বিতীয়টি মরা কুমার নামে পরিচিত। এ নদের গড় প্রস্থ ৪৪ মিটার। দুটি ধারা মিলে কুমারের মোট দৈর্ঘ্য ১৯৪ কিলোমিটার। কুমারের একটি ধারা গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাগদি ইউনিয়নের সেনদিয়া ঘাট এলাকায় মাদারীপুরের আড়িয়াল খাঁ ও গোপালগঞ্জের মধুমতী নদীর সংযোগ খালে (বিলরুট ক্যানেল) গিয়ে মিশেছে। অপর ধারাটি ভাঙ্গায় গিয়ে কুমারের মূল স্রোতোধারায় পড়েছে।

পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়েসহ নানাবিধ কারণে ফরিদপুরের ভাঙ্গার গুরুত্ব বেড়েছে। কথিত আছে কুমার নদের পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় ভাঙ্গার আগের নাম ছিল ‘কুমারগঞ্জ’। কুমারগঞ্জ কুমার নদের উত্তর পারে অবস্থিত ছিল। ১৮৮৯ সালে এখানে স্থাপিত হয়েছিল চৌকি আদালত। ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র নদের উত্তর পার নিয়ে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু একসময় নদের উত্তর ও দক্ষিণ পারের লোকদের মধ্যে কলহ–বিবাদের সৃষ্টি হয়। ফলে নদের উত্তর পারে দক্ষিণ পারের বাসিন্দাদের যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল, তা ভেঙে তাঁরা দক্ষিণ পারে গিয়ে বাজার স্থাপন করেন। এ ঘটনায় ওই এলাকার মানুষের মুখে মুখে কুমারগঞ্জের নতুন নাম ‘ভাঙ্গা বাজার’ হিসেবে ফিরতে থাকে। সেই থেকেই জায়গাটির নাম হয়ে যায় ভাঙ্গা। কালের অতলে হারিয়ে যায় কুমার নদের স্মৃতিবিজড়িত কুমারগঞ্জ।

ষড়ঋতুতে নানা চেহারায় কুমার ধরা দেয় ফরিদপুরবাসীর কাছে। বর্ষায় নদের দুকূল ছাড়িয়ে বন্যার পানি ঢোকে শহরে ও গ্রামে। ৭ থেকে ১৫ দিন স্থায়ী হওয়ার পর নেমে যায় পানি, রেখে যায় শস্যের প্রাণ পলিমাটি। বর্ষার উন্মাদনা থমকে যেতে থাকে শরতে। তখন নদের ভরা যৌবন, দুই পারে কাশবনের সমারোহ। হেমন্তে পানি কমে সর্পিল আকার ধারণ করে, শীতে কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে বের হয়ে আসতে চলে যায় অনেকটা সময়। এভাবে বসন্ত ও গ্রীষ্ম পার হয়ে আবার আসে বর্ষা, নদের সেই উন্মাদ রূপ।

কুমারের গলায় প্রথম মালা পরানো হয় ১৯৩৫ সালে। ওই বছর প্রথম সেতু নির্মাণ করা হয়। ওই সেতুর নাম আলিমুজ্জামান সেতু। এই সেতুটি ফরিদপুর শহরের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ ঘটায় সড়কপথে। বর্তমানে অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে কুমারের বুকে। বন্যা ঠেকানোর নামে নদের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বন্ধ করতে মদনখালীতে নদের উৎসমুখে দেওয়া হয় স্লুইসগেট। এভাবে মানুষ তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী কুমারকে বশে রাখতে যাওয়ায় এক সময় মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয় কুমার। নদের তলদেশ ভরাট হয়ে যেতে শুরু করে। অবৈধ দখলদারেরা দুই পার থেকে নদকে গ্রাস করতে শুরু করে।

এ প্রেক্ষাপটে কুমার নদ বাঁচাও আন্দোলন শুরু হয়। একপর্যায়ে ‘কুমার নদ পুনঃখনন প্রকল্প’ হাতে নেয় ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। মৃতপ্রায় এ নদকে খনন করে স্রোতস্বিনী করে তোলা, নদের পারের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে শহরের অংশে নদের দুই পার দৃষ্টিনন্দন করে তোলা এ প্রকল্পের লক্ষ্য।

কুমার নদের দুই পারের জায়গা অবৈধ দখলদারদের খপ্পরে চলে গেছে। বিশেষত শহরের ৯ কিলোমিটারের মধ্যে দখল সবচেয়ে বেশি। এ দখলের মধ্যে দোকানপাট, বাড়িঘর যেমন আছে, তেমনি রয়েছে মসজিদ ও মন্দির। বিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর, ইটভাটা, বেকারিসহ হরেক রকমের ছোট ও মাঝারি কারখানা করা হয়েছে নদের পার দখল করে।

২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর ‘কুমার নদ পুনঃখনন’ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন করা হয়। প্রকল্প ব্যয় ছিল ২৫০ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০১৬ জুলাই শুরু হয়ে এ প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় মেয়াদ আগামী ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

দখলের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত দূষিত করা হচ্ছে নদকে। প্রতিদিন ফরিদপুর পৌরসভার চারটি নর্দমার নোংরা পানি কোনো শোধন ছাড়াই ফেলা হচ্ছে এ নদে। পাশাপাশি মাছ ধরা ও চাষের জন্য মাঝেমধ্যে বাঁশের খুঁটি ও জাল দিয়ে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হয়েছে। খননযন্ত্র বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হচ্ছে নদের বুক থেকে। বাঁশের বেড়া দিয়ে ধরা হচ্ছে মাছ।

শহরের তিতুমীর বাজার, হাজী শরীয়তুল্লাহ বাজারসহ আশপাশের সব বাজারের বর্জ্য, শাকসবজি, মাছ, মুরগি, গরুর উচ্ছিষ্ট ফেলা হচ্ছে নদে। কারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, সুযোগ পেলে পৌরসভার বর্জ্যসহ এহেন বর্জ্য নেই, যা প্রতিনিয়ত নিক্ষেপ করা হয় না কুমার নদের বক্ষে।

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সভাপতি আওলাদ হোসেন বলেন, ‘কুমার নদ আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। কুমারকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের।’

ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোস বলেন, ‘কুমার নদ আমাদের প্রাণ। যেকোনো মূল্যে এ নদকে আমরা বাঁচিয়ে রাখব।’

কুমারকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছে ফরিদপুরবাসী—আবার স্রোতস্বিনী নদ হয়ে উঠবে কুমার। গোসলের সময় এ নদে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেবে দুরন্ত কিশোর–তরুণ। এ নদের পানিতে নৌকা ভাসিয়ে মাঝি ভাসবে ভাবের সাগরে, ‘কান্দিয়া আকুল হইলাম ভব নদীর পাড়ে, মন তরে কে বা পার করে…।

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com