গণতন্ত্রের অপমৃত্যুতে রক্তাক্ত চট্টগ্রাম


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ১১:৫২ অপরাহ্ণ /
গণতন্ত্রের অপমৃত্যুতে রক্তাক্ত চট্টগ্রাম
সৈয়দ মুন্তাছির রিমন
বন্দর নগরী হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম। দেশের অর্থনীতির প্রধান সমুদ্র বন্দর এলাকা। ২০২১ সালের অগ্রযাত্রায় বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন হয়েছে। একটি রাষ্ট্রের জনগণের গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার হলো ভোট।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। জনগণ তাদের এ ভোটাধিকার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে থাকে। পৃথিবীর বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমাদের দেশের মতো জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের সমান ভোটাধিকার থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের অংশ গ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে। যা জনগণ তাদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে কার্যকর করে থাকে।
রাষ্ট্র ও সরকার এক নয়। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো রাষ্ট্র স্থায়ী। অপর দিকে সরকার অস্থায়ী। পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধির পরিবর্তন ঘটে। চারটি অপরিহার্য উপাদান সমন্বয়ে রাষ্ট্র গঠিত। যথা- জনসংখ্যা, ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। সরকার রাষ্ট্রের একটি মাত্র অংশ, যা রাষ্ট্রের পক্ষে কার্য সম্পাদন করে। সরকার রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরূপে কাজ করে। এটি রাষ্ট্রের এমন একটি প্রতিনিধি, যা রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষাকে আইনে পরিণত করে, রাষ্ট্রে আইনগুলোর বাস্তবায়ন করে এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করে। রাষ্ট্র বিমূর্ত, অপর দিকে সরকার মূর্ত। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসরত ব্যক্তিসমষ্টির সার্বভৌম অধিকার রক্ষার ধারণা রাষ্ট্র ব্যক্ত করে। রাষ্ট্র অদৃশ্য।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮তে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করবেন। সংবিধানের ১১৮(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) উপ-অনুচ্ছেদগুলোয় নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণের পদ্ধতি বর্ণিত আছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বা তাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপরে ন্যস্ত থাকে।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারী সিটি নির্বাচনে চট্টগ্রামজুড়ে সারাদিন অবিরাম সহিংসতা-নৈরাজ্য-হত্যা-নারীনির্যাতন-ভোটডাকাতি, খুন, দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হলো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। গোপনকক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে ভোটারদের। নির্বাচন নিয়ে এই নৈরাজ্যকর অবস্থার কারণে সকালের পর থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কমতে শুরু করে। সকাল আটটা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত চলে। কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের জেরে কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।বিএনপি অভিযোগ করে, আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ভোটকেন্দ্র থেকে ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ইউসেফ আমবাগান স্কুল কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী ও বিদ্রোহী প্রার্থী মাহমুদ উল্লাহর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। নির্বাচনের দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আধিপত্য বিস্তারের জেরে এই সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মো. আলাউদ্দিন। নগরের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণের সময় ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামের বাকলিয়া টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্র, ওয়াপদা কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট দেওয়ার গোপনকক্ষে প্রত্যেক ভোটারের সঙ্গে একজনকে থাকতে দেখা গেছে। একজন ভোটার জানিয়েছেন, তাঁর ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। এ ছাড়া বিএনপির এক নারী এজেন্ট অভিযোগ করেন, তাঁকে হকিস্টিক দিয়ে মারধরের পর কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার এতো বছরে দেশে যত নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সেগুলোর কোনোটিই দুর্নীতি, ভোট কারচুপি, অস্ত্র ও মাস্তানির ব্যবহার, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধাদান, ফল বদল বা ভোটারবিহীন নির্বাচনের ফল ঘোষণার মতো অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কারণেই নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে। অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে হলে সংবিধানের সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত ও সংশোধন করা প্রয়োজন। তাই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সাংবিধানিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হবে মুশকিল। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো নির্বাচনী সরকার-সংক্রান্ত বিরোধ। সংবিধানের সংশোধন ছাড়া, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দলীয় সরকার অথবা অন্য কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না। তাই বর্তমান ২০২১ সালের সকল নির্বাচনের সুস্থ পরিবেশ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার জন্য সর্বাঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্টিত কোন বিকল্প নেই।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ফ্রান্স।
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com