সাহিত্যিক সমাজ : ভাষা আন্দোলনের স্নায়ুযোদ্ধা


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ১১:৫৩ অপরাহ্ণ /
সাহিত্যিক সমাজ : ভাষা আন্দোলনের স্নায়ুযোদ্ধা
শেখ সায়মন পারভেজ,
 ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে দেশ বিভক্তির কথা যখন নিশ্চিত হয়, তখন  মে মাসে চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ  উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে সর্বপ্রথম  প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন  ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. মোঃ এনামুল হক সহ কয়েকজন সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ও ২২শে ফেব্রুয়ারিতে  পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা এবং ২৪ তারিখে পুলিশ কর্তৃক শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার প্রতিবাদে একুশের চেতনাকে লালন করে বহু সাহিত্যিক অনেক গল্প , নাটক,কবিতা রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া কোন একক ঘটনা নিয়ে আর তত বেশি কবিতা, গল্প লেখা হয়নি। একুশের কবিতা গভীরভাবে জনগনকে যতটুকু আলোড়িত করেছিল, অন্য কোন বিষয় তা পারেনি। মাহবুব আলম চৌধূরীর দীর্ঘ কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ একুশের চেতনাকে নিয়ে রচিত অন্যতম কবিতা। এসব কবিতায় ক্রোধ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও প্রতিশোধের বাণী ধ্বনিত হয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমানের “একুশের ফেব্রুয়ারি” সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে বহু কবিতা। কবিতার প্রতিটি শব্দ উত্তাল করেছিল  বিবেককে ।
বায়ান্ন সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদের রক্ত যেখানে ঝরেছিল সেখানে গড়ে উঠেছিল স্তৃতিস্তম্ভ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক তা ভেঙ্গে দেয়। তরুণ কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ পুলিশ কর্তৃক শহীদ মিনার ভাঙ্গার  প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।  প্রতিবাদ,ঘৃণা কাজ করার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হলে বসে রচনা করেন” স্মৃতির মিনার” কবিতাটি । তাৎক্ষণিক আলাউদ্দিন আজাদ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন-
 “স্মৃতির কিনার ভেঙ্গে সে তোমার
ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো-
চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো।”
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা “আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো” শীর্ষক কবিতাটি পরবর্তী সময়ে একুশের জনপ্রিয় গান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে রচিত হয়েছে বহু নাটক ও কথা সাহিত্য।  ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় থাকার অপরাধে রাজবন্দি হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারগারে বন্দী ছিলেন মুনীর চৌধুরী। এমনই এক সময়ে তার কাছে একটি চিঠি লিখেন রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত। অসাধারণ এক প্রস্তাব ছিল সেই চিঠিতে, প্রথম শহীদ দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লেখার অনুরোধ করেছিলেন তিনি।
মুনীর চৌধুরী লিখলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম এক কালজয়ী নাটক, নাম দেওয়া হলো ‘কবর’।  নাটকটির সমগ্র ঘটনাস্থল ছিল গোরস্থান, ভাষা শহীদদের লাশ গুম করার নীলনকশা  বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের জন্য ছিলেন ইন্সপেক্টর হাফিজ। নাটকের শুরু থেকেই অসৎ নেতাকে মদ্যপানে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়, সুযোগ পেয়ে লোভী হাফিজও নেতার সাথে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শেষ চিহ্নটুকু ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা করতে থাকেন তারা। সবকিছু যখন পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছিল, তখুনি মুর্দা ফকির নামক এক চরিত্রের আগমন ঘটে, আধপাগল এই মানুষটি যেন সমাজের বিবেক হিসেবে আবির্ভূত হন। লাশগুলো এখনো জীবিত আর তাদের কবর থেকে উঠিয়ে তিনি মিছিল করবেন– এমন অদ্ভুত একটি কথা বলে তাদের ভড়কে দেন মুর্দা ফকির। এরপর কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার আবর্তনে এগিয়ে গেছে সম্পূর্ণ গল্প। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এদেশের মানুষের ভাষা সংস্কৃতিকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল।   কথা সাহিত্যেও একুশের ঘটনা স্থান পেয়েছে। রচিত হয়েছে বহু গল্প উপন্যাস। শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’ গল্পে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট প্রতিফলিত হয়েছে। তাছাড়া আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’ আতোয়ার রহমানের ‘অগ্নিবাক’ অন্যতম একুশের গল্প। উপন্যাস হিসেবে জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’ সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’ অন্যতম। মূলত একুশের ঘটনা বাঙালির নিজের দেখা অভিজ্ঞতার ঘটনা। এ অভিজ্ঞতা বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে। একুশ আমাদের প্রাণ। এ নিয়ে রচিত সাহিত্য আমাদের মনে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমাদের মনে শক্তি জোগায়। আমাদের উদীপ্ত করে, প্রতিবাদী করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রেরণা সৃষ্টি করে। তাই একুশের প্রসূত সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা আমাদের জাতীয় জীবনে অনস্বীকার্য। বাংলা সাহিত্য এবং বাংলাদেশের সাহিত্য বলে দুটি কথা আছে। মূলত বাংলাদেশের সাহিত্যের যাত্রা একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে। এই একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকেই বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশি মানুষের জীবন প্রণালী উন্মোচিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছ। আজীবন স্মৃতিতে থাকুক ভাষা আন্দোলনের  স্নায়ুযোদ্ধরা।
সাহিত্যিক ও মানবাধিকারকর্মী
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com