বাঙালি জাগরণের দলিল বঙ্গবন্ধুর বই


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় : আগস্ট ১০, ২০২১, ২:০৮ পূর্বাহ্ণ /
বাঙালি জাগরণের দলিল বঙ্গবন্ধুর বই

যুগে যুগে কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেন, যাঁদের কাছে পরাজিত হয় সময়, তাঁরা অতিক্রম করেন মহাকালকে। তাঁরা ইতিহাসের পাতায় নয়, প্রতিটি মুহূর্তে থাকে জীবন্ত বর্তমান হয়ে। আলোকবর্তিকা হয়ে থাকেন ভবিষ্যতের জন্য। তেমনি একজন বাঙালি মহাপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর ব্যক্তিত্ব হিমালয় শৃঙ্গের চাইতে উঁচু, যাঁর হৃদয়ের বিশালতার কাছে হার মেনেছে মহাসমুদ্র। যাঁর সংগ্রাম ছিল আজীবন শোষিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য। ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক নিরঞ্জন মজুমদার ‘বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, ‘দেশে দেশে অনেক নেতা জন্মায়, কেউ ইতিহাসের একটি পঙক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউবা একটি অধ্যায়, কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু হলেন সমগ্র বাংলার ইতিহাস’। তিনি সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে নিয়ে ধ্বংস বিভীষিকার উপর দাঁড়িয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রের সূচনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এর পরাজিত শক্তির দোসরেরা মাত্র ৫৫ বছর বয়সে নৃশংসভাবে হত্যা করেন বাংলা মায়ের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানটিকে। (১৯২০-১৯৭৫) সময়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, দর্শন, চেতনা সম্পর্কে জানা যায়, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে লিখিত বইগুলো থেকে। ২০১২ সালে ইউপিএল প্রকাশ করে হাতে লেখা ডায়েরী ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষে একুশের বইমেলায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এই তিনটি বই বর্তমানে বাঙালি পাঠকদের কাছে সুখপাঠ্য বই হিসেবে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। আমরা যারা’৭৫ এর পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু প্রতিচ্ছবি বঙ্গবন্ধুর বই ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত বই। তিনটি বইয়ে সহজ সরল ভাষায় বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্ম, বংশ, শিক্ষাজীবন, ভাষা আন্দোলন, কলকাতায় রাজনীতি, বিদেশ ভ্রমণ এবং ষাটের দশকে কারাজীবনের কথামালা সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন। যা সববয়সী পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘একজন মানুষ হিসেবে আমি সমগ্র মানবজাতিকে নিয়ে ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্প্রীতির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’’পৃষ্ঠা-১। বঙ্গবন্ধুকে নিজেকে একাধারে মানুষ এবং তাঁর সঙ্গে বাঙালি হিসেবে আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এই আত্মপরিচয় থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন। যার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাঙালি জাতিসত্তা, জনসম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর বই পাঠে আমরা দেখতে পাই ছাত্রজীবনে তার কর্মকাণ্ড ছিল ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী। শিক্ষকদের প্রতি ছিলেন বিনম্র শ্রদ্ধাশীল। বঙ্গবন্ধুর লিখা থেকে আমরা প্রমাণ পাই সমাজসেবার পাঠ তিনি নিয়েছেন শিক্ষকের কাছ থেকে। ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. জুবেরি বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালোবাসতেন। ১৯৪৩ এর মন্বন্তরের সময় অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হলে অধ্যক্ষ মাঝেমধ্যে খবর নিতেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে, ‘বেকার হোস্টেল এর সুপারিনটেনডেন্ট প্রফেসর সাইদুর রহমান সাহেব আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন’ পৃ-১৮। লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন ‘‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় থাকার সময় ও অধ্যাপক সাইদুর রহমানের পায়ে হাত দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে দেখেছি।’’
পৃথিবীর বিখ্যাত রাজনীতিবিদরা প্রচুর পড়াশোনা করতেন, বঙ্গবন্ধু তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। একাডেমিক বই ছাড়াও তিনি প্রচুর শিল্প সাহিত্যের বই পড়তেন। তার ভাষণ, বক্তৃতা, চিঠিপত্র আর লিখিত বইগুলো পাঠ করে আমরা সেটির প্রমাণ পাই। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকদের রুদ্ররোষে ২৪টি মামলায় তিনি ১৮ বার জেলে নিক্ষিপ্ত হন। প্রায় ১২ বছর জেল খেটেছেন। ১০ বছর ছিলেন কড়া নজরদারিতে। জেলবন্দি নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে পড়ালেখা ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে, ‘‘দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাই না। আব্বা আমাকে এ সময় একটি কথা বলেছিলেন- বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না’’ পৃ-২১। পরবর্তীতে আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাড়িতে ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে শোভা পেত জর্জ বার্নার্ড শ, বাট্রান্ড রাসেল, আল বেরুনী, মাও সেতুং, এমিলি জোলার মত বিখ্যাত লেখকদের বই। বঙ্গবন্ধুর ব্রতছিল সাম্প্রদায়িকতা ও পরশ্রীকাতরতার বিরুদ্ধে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক। আমাদের তরুণ সমাজ সাম্প্রদায়িকতার কুমন্ত্রে মাঝে মাঝে পথভ্রষ্ট হয়। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘‘আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটি দিক আছে। একটা হল-আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি’’ পৃষ্ঠা-৪৭। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৫৩ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে দলটির নামকরণ করেন ছাত্রলীগ। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ শব্দ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেন। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতিবিদদের তালিকায় বঙ্গবন্ধুর মত নেতৃত্ব পৃথিবীতে বিরল।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২২৮ ও ২২৯ পৃষ্ঠায় সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ অনুরাগের কথা জানতে পারি। শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তব্য দেওয়ার পর ভারতের প্রতিনিধি মনোজ বসু ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি লিখেছেন- মনোজ বসু বললেন, ‘‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক। কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ, আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরা তাঁর জন্য গর্ব অনুভব করি’’ পৃ-২২৯। বঙ্গবন্ধুর অন্তরে ছিল বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। তিনি কাজী নজরুলের কবিতা থেকে ‘জয় বাংলা’ ‘বাংলাদেশ’ শব্দগুলো নিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ২৫ মে ঢাকায় কবি নজরুলের বাসায় যাওয়ার সময় তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করতে করতে পথ হেঁটেছেন। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী থাকাকালে নির্বাক নিশ্চল নজরুলকে কলকাতায় দেখতে যান। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় বিদেশী কবি সাহিত্যিকদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে লিখেছেন- ‘‘মনে রেখ থরোর কথা- Under a government which imprisons any unjustify, the place for a just man is also a prison. পৃষ্ঠা-২২৬. বঙ্গবন্ধুর বই পাঠে আমরা দেখি পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠীর চরম নির্যাতন, আর্থিক সংকট, পরিবারের প্রতি ভালোবাসার কষ্ট তিনি অনুভব করেছেন। কিন্তু অন্যায়ের কাছে আপোষ করেননি। কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন- ‘এটা ক্ষমতা দখলের নয় জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার সংগ্রাম।’ তিনি বিশ্বাস করতেন ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।’’
বঙ্গবন্ধুর অমর সৃষ্টি ‘আমার দেখা নয়াচীন’। তিনি জীবনের শুরু থেকেই বাঙালি জাতির জন্য বারবার খুঁজে দেখতে চেয়েছেন এমন একটি প্রণালী যেখানে মানবতা আর মর্যাদা একই জীবনে সমান্তরাল দৈর্ঘ্য ছুঁয়ে যায়। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান এন্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স-এ পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু নয়াচীন সফর করেন। ৩৭টি দেশের প্রতিনিধি উক্ত সম্মেলনে যোগদান করে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগ দেন আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, ইউসুফ হোসেন ও বঙ্গবন্ধু যোগ দেন। গ্রন্থটির শুরুতে দেখা যায়, তরুণ বয়সেই লেখক প্রাঞ্জল জাতি গঠনের তৃষিত ন্যায্য দৃষ্টি পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘১৯৫২ সালে জেল থেকে বের হলাম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, ‘‘যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও। অল্পদিনের মধ্যে তারা কত উন্নতি করেছে।’’ চীন ভ্রমণে বঙ্গবন্ধু যেখানে গেছেন তাঁর দূরদর্শিতা দিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন সবকিছু বাঙালির সাথে মেলানোর এবং তুলনামূলক পার্থক্যের চেষ্টা করেছেন। চীনে পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রদূত ঢাকার লোক। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘রাষ্ট্রদূত অনেক জাঁকজমকের সাথে থাকেন। বিরাট অফিস, বহু কর্মচারী তাঁকে সাহায্য করেন। দেখে মনে হলো, যাদের টাকা দিয়া এত জাঁকজমক অবস্থা তাঁদের চিন্তা করলেই ভালো হতো। তারা কেউ না খেয়ে রাস্তায় ঘোরে। তাদের ভাতও নাই, কাপড়ও নাই। থাকবার মতো জায়গাও নাই। তাদের সামনে ছেলে মেয়েরা না খেয়ে তিলে তিলে মারা যায়। নীরবে শুধু অশ্রু বিসর্জন করে খোদার কাছে ফরিয়াদ জানাই। জানি না খোদার কাছে সে ফরিয়াদ পৌঁছে কিনা’’ পৃষ্ঠা-২৩। বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন সময়ে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় কাজে লাগিয়েছেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণেও এই অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারিয়েছি। কিন্তু হৃদয়ে অনুভবে লাখো বাঙালির মনের গভীরে তিনি জীবন্ত আছেন। ২০০৪ সালে তাঁর একটি প্রমাণ পাওয়া গেল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি ২০০৪ সালে আয়োজন করে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ এই শিরোনামে জরিপ। সারাবিশ্বের ২ কোটি ৫০ লক্ষ শ্রোতা এতে অংশ নেন। ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ) সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির নাম ঘোষিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৫ বছর পরও আমাদের বাঙালির ভাবনায় অধিকন্তু জুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধু। তাঁর বইয়ের প্রতি অনুরাগ, আগ্রহ ও ভালোবাসা মনের মাঝে সৃষ্টি করছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে আমার বিশ্বাস বইগুলোর প্রতিটি লাইন বারবার পঠিত হবে। সার্থক হয়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর শান্তিবাদী, অহিংসপন্থী, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথচলা। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর বই হোক বাঙালির জাগরণের দলিল।
লেখক : ইতিহাস বিষয়ক গবেষণাকর্মী

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com